তিশি কিছুটা অপরিচিত কিন্ত পুষ্টিগুণে কতটা সমৃদ্ধ
![]() |
তিশি |
তিসি তেল ও আঁশ উৎপাদনকারী
গুল্ম। মিশরে লিনেন জাতীয় বস্ত্র তৈরীতে এর ব্যবহার শুরু হয়। তবে বর্তমানে তেলের জন্য বীজ এবং আঁশের জন্য এ
উদ্ভিদকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। এটি ৩০ থেকে ৮০
সেঃ মিঃ উঁচু হয়। ফুল নীল, সাদা বা হালকা গোলাপী হয়। প্রতিটা ফুলে পাঁচটি করে পাপড়ি থাকে। ভোর বেলা
ফুল ফোটে এবং বিকালে ঝড়ে যায়। যায়। কান্ডের বাকল বা ছাল থেকে আঁশ তৈরি হয়। আশ সংগ্রহের জন্য উদ্ভিদের
কান্ড পানির নিচে ৭-২১ দিন রেখে আঁশ সংগ্রহ করা হয়। জাগ দেওয়া ও আঁশ সংগ্রহ, পাট হতে আঁশ সংগ্রহের
মতো।
তিসি
বীজ। যার ইংরেজি নাম ফ্লেক্স সিড। আমরা যাকে তিসি হিসেবেই চিনে থাকি। তিসি বীজ
আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ভালো একটি খাবার। তিসি বীজ ফাইবার, ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের প্রধান উৎস। আমাদের দেশে
বাদামি ও হলুদ রঙের তিসি বীজ বেশি পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম বীজে আছে- ৫৩৪ কিলোক্যালরি, ১৮.২৯ গ্রাম আমিষ, ২৭.৩ গ্রাম স্নেহ, ২৮.৮৮ গ্রাম শর্করা, ১.৬৪ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ০.১৬১ মিলিগ্রাম রাইবোফ্লাভিন, ৩৯২
মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ৬৪২ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৮১৩ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ৪.৩৪ মিলিগ্রাম জিঙ্ক, ০.১৭৪ মিলিগ্রাম ম্যাংগানিজ, ৮গ্রাম খাদ্য আঁশ ও ৬ মাইক্রোগ্রাম
ফলেট। এতো পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খুব কমই রয়েছে। অনেকেই তিসি খেয়ে থাকেন নানা
ভাবে। আবার অনেকের তেমন পছন্দ নয়। কিন্তু এর পুষ্টিগুণের তালিকা থেকে নিশ্চয়ই
বুঝতে পারছেন এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতোটা উপকারী।
![]() |
তিশি |
চলুন তবে দেখে নেয়া যাক তিসি বীজের কিছু স্বাস্থ্যকথা।
তিসি বীজ উচ্চমাত্রার
আঁশ এবং কম শর্করাযুক্ত: তিসিবীজে
একধরনের জেলির মত খাদ্য আঁশ থাকে,
যা পানিতে দ্রবণীয় তাই এটি শরীরের আভ্যন্তরীণ
অঙ্গের জন্য অবিশ্বাস্য রকমের উপকারী। যা পাকস্থলীকে দ্রুত খালি করতে সাহায্য করে
যার ফলে পুষ্টি উপাদান দেহে ভালো ভাবে শোষিত হতে পারে। তিসিবীজে দ্রবণীয় এবং
অদ্রবণীয় দুই ধরনের আঁশ থাকায় তা কোলনের বিষাক্ততা দূর করতে সাহায্য করে, ওজন কমাতে এবং চিনি খাওয়ার ইচ্ছাকে কমাতে সাহায্য করে।
সুন্দর ত্বক ও চুলের
জন্য: তিসি আমাদের চুল ও ত্বকের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি
শস্য। স্বাস্থ্যবান ত্বক, চুল ও নখ পেতে প্রতিদিনের পানীয়তে ২ টেবিল চামচ তিসিবীজ
রাখুন বা ১ টেবিল চামচ তিসির তেল রাখুন প্রতিদিনের খাওয়াতে।তিসিবীজে থাকা আলফা
লিনোলেইক এসিড ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাট সরবরাহ করে যা ত্বকের রুক্ষতা ও
শুষ্কতা দূর করতে সাহায্য করে। ত্বকের অ্যাকজিমা, ব্রনের
সমস্যা দূর করে এটি। নিয়মিত এটি খেলে ত্বক এবং চুল আভ্যন্তরীণ ভাবে স্বাস্থ্যবান
হয়। এটি ব্রণ ও
যেকোন চামড়া জাতীয় রোগ প্রতিরোধ করে। এটি মাথায় খুশকি হতে দেয় না এবং মাথার ত্বকের
ময়েশ্চারাইজার ঠিক রাখে।
ওজন কমাতে: তিসিবীজে থাকা স্বাস্থ্যকর ফ্যাট
ও আঁশ আপনাকে অনেক্ষন পেট ভরা থাকার অনুভূতি দেয় যার ফলে কম ক্যালরি গ্রহণ করা হয়
এবং ওজন কমে। ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডের ALA অর্থাৎ
আলফা লিনোলেইক এসিড শরীরের উদ্দীপ্ততা কমাতে সাহায্য করে। উদ্দীপ্ত শরীরের সব সময়
প্রবণতা থাকে অতিরিক্ত ওজন ধরে রাখার। তাই ওজন কমাতে প্রতিদিনের খাবার তালিকায়
স্যুপ, সালাদ ও যেকোনো পানীয়ের সাথে কয়েক চা চামচ তিসিবীজ রাখুন।
কোলেস্টেরলের মাত্রা
কমাতে সাহায্য করে: : তিসিবীজের দ্রবণীয় আঁশ চর্বি ও কোলেস্টেরলকে
হজমতন্ত্রের মাঝে এমন ভাবে আঁটকে ফেলে যে আর দেহে শোষিত হতে পারে না। গবেষণা থেকে জানা গেছে, তিসিবীজ প্রাকৃতিক ভাবে আমাদের শরীরের HDL গুড কোলেস্টোরাল বাড়ায় এবং খারাপ কোলেস্টোরালকে কমায়।প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় তিসি রাখুন। এতে করে রক্তের
কোলেস্টোরলের মাত্রা কমে যাবে।
গ্লুটেন ফ্রি: : তিসিবীজ
গ্লুটেন
বা আঠালো সমৃদ্ধ খাবার গুলোর
চমৎকার বিকল্প হতে পারে। কারন গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাবার গুলো প্রদাহী অপরদিকে তিসি
হচ্ছে প্রদাহবিরোধী। তাই যাদের সিলিয়াক ডিজিজ বা বা গ্লুটেন অ্যালার্জি রয়েছে তাদের জন্য তিসিবীজ হতে
পারে চমৎকার একটি খাবার। আবার যাদের সামুদ্রিক মাছের ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডে
অ্যালার্জি রয়েছে তাদের জন্য ও চমৎকার বিকল্প হতে পারে।
তিসিবীজ
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ: তিসিবীজ
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ। যা অ্যান্টিঅ্যাজিং, হরমোনের
ভারসাম্যতা এবং কোষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খুবই উপকারী।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে: তিসিবীজ রক্তে
চিনির মাত্রা কমায় যা ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখে। যারা ডায়াবেটিসের রোগী তাদের ইনসুলিন নেয়ার প্রয়োজন
নেই যদি এই তিসি সেবন করে থাকেন দৈনিক অন্তত ১৫-২০গ্রাম তিসি। আর যাদের ডায়াবেটিস
নেই তারা যদি এটি গ্রহণ করে তবে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে
কাজ করে: তিসিবীজ স্তন, প্রোস্টেট, ওভারিয়ান এবং কোলন
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে। তিসিবীজে থাকা ৩ ধরনের লিগ্নান্স,
দেহে থাকা হরমোনের প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা বজায় রাখে যা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
উচ্চ মাত্রার ওমেগা ৩
ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ
আমরা ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডের উপকারিতার কথা কম বেশি সবাই জানি। তিসিবীজের ওমেগা ৩
ফ্যাটি এসিডে থাকে আলফা লিনোলেইক এসিড(ALA) যা
আমাদের দেহে সহজে কাজ করতে পারে। এই
আলফা লিনোলেইক এসিড (ALA) হচ্ছে একটি স্বাস্থ্যকর
ফ্যাট। তিসিতে
রয়েছে উপকারী ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড ও এমাইনো এসিড যা দেহের
ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে ও রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং বিপি কমাতে সহায়তা করে। যারা হাই ব্লাডপ্রেসারের রোগী
তারা তাদের খাদ্য তালিকায় তিসি
রাখতে পারেন। প্রতিদিন ২চামচ তিসির পাউডার এর জন্য যথেষ্ট।
● যারা তামাক বা অন্য নেশায়
আক্রান্ত থাকে তাদের জন্য তিসি খুবই উপকারী।এটি নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে মুক্তি
দিতে হবে। প্রতিদিন খাওয়ার পর অল্প পরিমাণ তিসি চাবালে দ্রুত নেশা থেকে মুক্তি
পেতে পারেন একজন রোগী।
● তিসি আমাদের হৃদপিণ্ডকে সবল
রাখতে কাজ করে। তিসি বীজে রয়েছে আলফা লিনোলিক
এসিড যা হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে।
● তিসি আমাদের হতাশা ও
দুশ্চিন্তা দূর করে। মেজাজ ফুরফুরে রাখে।
● এটি আমাদের শরীরের ক্যলসিয়াম
লেভেল বাড়ায়। ফলে হাড় ও শরীরের জয়েন্টগুলো সুস্থ থাকে। ফলে বৃদ্ধ বয়সে হাড্ডিজনিত
রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
● তিসি বীজ মেয়ে এবং ছেলেদের fertility বাড়ায়। এমন কি মেনোপোজের সময়
ব্যথা দূর করতেও তিসি অনেক উপকারী।
- - তিসির
ফ্যাটি এসিড ক্যারোটিন হতে দেহে ভিটামিন 'এ'
তৈরিতে সাহায্য করে। এতে করে দেহের
ভিটামিন এ এর ঘাটতি পূরণ হয়। শিশুদের ছোটবেলা হতে তিসি খাওয়ার অভ্যাস করলে
ভিটামিন এ ঘাটতি জনিত রোগ থেকে মুক্তি পাবে।
তিসি হচ্ছে আঁশসমৃদ্ধ, প্রোটিন, ক্যলসিয়াম,এন্টি অক্সিডেন্টস, ওমেগা-৩ ফ্যাটি
এসিড এবং মিনারেলের একটি অসাধারণ সমন্বয়। এতে ভিটামিন বি কপ্লেক্স, ম্যাঙ্গানিজ ও ম্যাগনেসিয়াম
প্রচুর পরিমাণে থাকে। তিসি আমাদের শরীরে এন্টি অক্সিডেন্টের কাজ করে দেহকে
শক্তিশালী রাখে এবং সহজে ক্লান্ত হতে দেয় না।
কোথায় পাওয়া যায়:
তিসিবীজ আমাদের দেশেও চাষ হয় কিন্তু অন্যান্য
শস্যের মত এতো পরিচিত নয়। তিসি সাধারণত অর্গানিক খাবার যেসব দোকানে পাওয়া যায়
সেখানে পাবেন। এছাড়া মশলার দোকানে বা বীজ যেসব দোকানে বিক্রি করে সেখানেও পেতে
পারেন।
0 comments:
Post a Comment